গ্রীষ্মের তাপে নিরাপদ দৌড়: সচেতনতা ও প্রস্তুতির কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা

গ্রীষ্মের তাপে নিরাপদ দৌড়: সচেতনতা ও প্রস্তুতির কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা

গ্রীষ্মের তাপে নিরাপদ দৌড়
গরমে দৌড়ানো: কীভাবে শরীর তাপের সঙ্গে খাপ খায়?

আমাদের শরীর প্রতিনিয়ত পরিবেশের সঙ্গে তাপের আদান-প্রদানে লিপ্ত থাকে। যখন আমরা ব্যায়াম করি, তখন শরীরে বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়, যার ফলে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাও বাড়ে। এই বাড়তি তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের শরীর একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে-তাপ উৎপাদন ও তাপ হ্রাসের মধ্যে।

শরীর কীভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণ করে?
আমাদের দেহ দুটি উপায়ে এই তাপ নিয়ন্ত্রণ করে:
১. রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে : শরীরের অভ্যন্তর থেকে ত্বকে তাপ স্থানান্তর করা হয়।
২. ঘাম ঝরানোর মাধ্যমে : ঘাম বাষ্প হয়ে ত্বক থেকে তাপ অপসারণ করে।
এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হলো একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করা-যেখানে যতটা তাপ উৎপন্ন হয়, ততটাই তাপ শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

কেন হঠাৎই দৌড়ানো কষ্টকর লাগে?
ব্যায়াম শুরু করলেই বিপাকীয় হার দ্রুত বেড়ে যায়, অথচ শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সাড়া দিতে একটু সময় নেয়। তাই দৌড় শুরুতে আপনি দুর্দান্ত অনুভব করলেও, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ক্লান্তি এসে যায়। শরীর তখনো সেই তাপ সামলাতে শেখেনি।

শরীরকে কীভাবে গরমে দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত করা যায়?
এই তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দক্ষ করে তুলতে হলে আমাদের শরীরকে বারবার একই রকম গরম পরিবেশে অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যস্ত করে তুলতে হয়। এটাকেই বলে অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে শরীর শিখে যায় কীভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে দৌড়ের সময় শরীর দ্রুত অতিরিক্ত উত্তপ্ত না হয়ে পড়ে।
এই প্রক্রিয়ায় শরীর শুধু তাপ নিয়ন্ত্রণে দক্ষ হয় না, বরং হৃদস্পন্দনের হারও স্বাভাবিক থাকে-ফলে আপনি আরামদায়কভাবে আগের মতোই গতি ধরে রেখে দৌড়াতে পারেন।
মানিয়ে নেওয়ার পর কী সুবিধা মেলে?
একবার শরীর গরমে মানিয়ে নিলে তা দৌড়ের সময় শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে:
• দৌড়ানো হয় আরামদায়ক
• ক্লান্তি কম লাগে
• হৃদস্পন্দনের হার নিয়ন্ত্রণে থাকে
• গরমেও আগের গতি ধরে রাখা যায়

কোন কোন বিষয় শরীরের তাপ প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে?
শরীরের তাপ প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে বিভিন্ন উপাদানের ওপর। কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যেমন:
• শরীরের ভর ও গঠন
• অ্যারোবিক ফিটনেসের স্তর
• পানি গ্রহণের পরিমাণ
আর কিছু বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেমন:
• আশপাশের তাপমাত্রা
• বাতাসের আর্দ্রতা
• আকাশে মেঘের পরিমাণ

কতদিনে শরীর তাপের সঙ্গে মানিয়ে নেয়?
সম্পূর্ণভাবে তাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাধারণত ১০ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে। প্রতিদিন গরম পরিবেশে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করলেই শরীরে বেশিরভাগ মানিয়ে নেওয়র লক্ষণ দেখা যায়।

গরমে নিরাপদে ও আরামে দৌড়ানোর জন্য ৮টি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

১. পানি পান করুন, বারবার

হাইড্রেশন শুধু পারফরম্যান্সের জন্যই নয়, তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীর তাপ সহজে ছাড়তে পারে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
• দিনে প্রতি ৩০ মিনিট পরপর পানি পান করুন, অথবা যখনই মুখ শুকনো লাগে।
• পুরুষদের জন্য দৈনিক ১৫.৫ গ্লাস এবং নারীদের জন্য ১১.৫ গ্লাস পানির পরামর্শ দেয়া হয়।
• ঘামের সঙ্গে হারানো ইলেক্ট্রোলাইট ও কার্বোহাইড্রেট পূরণে স্পোর্টস ড্রিংক বা হাইড্রেশন সাপ্লিমেন্ট কাজে দেয়।
• ৯০ মিনিটের বেশি দৌড়ানোর সময় হাইড্রেশন প্যাক বা পানির বোতল সঙ্গে নিন।

২. ঘড়ি ভুলে অনুভূতি অনুযায়ী দৌড়ান

উচ্চ তাপমাত্রায় আপনার গতি কমে যাওয়া স্বাভাবিক। এটাই আপনার শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা আপনাকে অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে রক্ষা করে। তাই গরমে দৌড়ানোর সময় পেস বা দূরত্বের চেয়ে আপনার অনুভূতির উপর, আপনার পরিশ্রমের মাত্রার উপর মনোযোগ দিন। যে গতিতে আপনি আরামদায়ক বোধ করেন, সেই গতিতে দৌড়ান এবং দুশ্চিন্তা করবেন না যে আপনি একটু ধীরগতিতে দৌড়াচ্ছেন। ধীরগতির আরামদায়ক ৩০ মিনিটের দৌড় একটি কষ্টকর ১২ মিনিটের দৌড়ের চেয়ে অনেক ভালো।

৩. হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরুন

গরমে দৌড়ানোর সময় বায়ু চলাচলযোগ্য সিনথেটিক কাপড় পরুন যা ঘাম শুষে নিয়ে দ্রুত শুকিয়ে যায়। সুতি কাপড় ধীরে শুকায় এবং আপনাকে আঠালো অনুভূতি দিতে পারে। এছাড়াও হালকা রঙের কাপড় পরা উত্তম, কারণ এটি বেশি তাপ প্রতিফলিত করে। তাপ থেকে অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য, ট্যাঙ্ক টপের পরিবর্তে শর্ট স্লিভ শার্ট পরুন, যা আপনার কাঁধ ও পিঠকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করবে।

৪. মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ধৈর্য ধরুন

শরীর তাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়। গরমে ধীরগতির অনুশীলন দীর্ঘ সময় ধরে শরীরকে উষ্ণ পরিবেশে রাখে, যা তাপ-সহনশীলতা বাড়াতে সহায়ক।

৫. কঠিন অনুশীলন ঠান্ডা আবহাওয়ায় করুন

গরমের তাপমাত্রা বেশি থাকে এমন সময়ে (সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা) দৌড়ানো এড়িয়ে চলুন, কারণ এই সময় সূর্যের তাপ বেশি থাকে এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। গরমে আপনার ট্রেনিং পরিকল্পনাকে আরও কৌশলগতভাবে সাজানোর জন্য সময় এবং পরিবেশ পরিবর্তন করুন। রেসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন? তাড়াতাড়ি সকাল অথবা সন্ধ্যায় দৌড়ানোর চেষ্টা করুন, যখন তাপমাত্রা কম থাকে এবং এবং গাছপালার ছায়াযুক্ত পরিবেশে দৌড়ানোর চেষ্টা করুন। আপনি চাইলে একটি দীর্ঘ দৌড়কে দুটি ছোট দৌড়ে ভাগ করতে পারেন।

৬. শরীর ঠান্ডা রাখুন

ছায়ায় থাকুন, মাথাযয় ঠান্ডা পানিতে ভেজানো ক্যাপ ব্যবহার করুন। অনেকে শরীর ঠান্ডা রাখতে আইস কিউব ব্যবহার করেন-এতে ঠান্ডা জল শরীর বেয়ে গলে পড়ে। শরীরের যত বেশি অংশ ঠান্ডা করা যায়, তত বেশি উপকার পাওয়া যায়।

৭. সূর্য থেকে নিজেকে রক্ষা করুন

• হ্যাট বা ভিজার ব্যবহার করুন।
• নন-স্লিপ সানগ্লাস ব্যবহার করুন যা ঘামে পড়ে না যায়।
• প্রতিদিনের জন্য SPF ১৫ সানস্ক্রিন যথেষ্ট-গরমে বারবার ঘামলে প্রতি ঘণ্টায় একবার পুনরায় মেখে নিন।

৮. তাপজনিত ক্লান্তির লক্ষণ চিনুন

তাপজনিত ক্লান্তির লক্ষণগুলো হলো:
• অতিরিক্ত ঘাম
• ঠান্ডা, ফ্যাকাশে বা স্যাঁতসেঁতে ত্বক
• দ্রুত কিন্তু দুর্বল হৃদস্পন্দন
• বমি বমি ভাব বা বমি
• দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এই লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে বিশ্রাম নিন, কাপড় ঢিলা করুন এবং শরীর ঠান্ডা করুন। প্রয়োজনে ঠান্ডা পানিতে গোসল নিন।

গরমে দৌড়ানো শুরুতে কঠিন মনে হলেও, সঠিক জ্ঞান, প্রস্তুতি ও ধৈর্য থাকলে তা নিরাপদ ও উপভোগ্য হতে পারে। শরীর কীভাবে তাপের সঙ্গে খাপ খায়, সেটি বোঝা এবং নিজের অনুশীলনকে সেভাবে মানিয়ে নেওয়া-এই দুটোতেই লুকিয়ে আছে সফলতার চাবিকাঠি।

Published on: Thursday, 8 May 2025, 02:28 pm | Last update: Sunday, 11 May 2025, 02:35 pm | Total views: 14.