বিশ্বের প্রথম ‘শতবর্ষী’ ম্যারাথনার ফৌজা সিং
“যে বয়সে বেশিরভাগ মানুষই জীবন সায়াহ্নে পৌছে শেষ প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করে, সেই বয়সে ফৌজা সিং একটি নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। এই গল্প এক শতবর্ষী ‘তরুণ’ ম্যারাথনারের গল্প, যিনি তার একাগ্রতা ও উদ্যমে বয়সের সীমানা পেরিয়ে লক্ষ্য ছুয়েছিলেন।”
ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলায় এক শিখ পরিবারে ১৯১১ সালের ১ এপ্রিল ফৌজা সিং এর জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পাঁচ বছর অব্দি তার পা এতোটাই দুর্বল ছিল যে সেগুলো হাঁটবার পক্ষেও অনুপযোগী ছিল। আর পুরো গ্রামে সব বাচ্চাদের মধ্যে সে এমন রোগা-পাতলা ছিল যে সবাই তাকে ডান্ডা (লাঠি) বলে ক্ষেপাত।
ফৌজা ছোটবেলায় তাদের কাছের স্কুলে যাওয়ার পুরো পথটুকুও হাঁটতে পারতেন না। শৈশবের সেই সময়গুলো ছিল অনেকটা অনিশ্চিত। পড়াশুনোর সুযোগ না হওয়ায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি তার বাবার সাথে পারিবারিক খামারে কাজে লেগে যান। তিনি স্কুলে যান নি বলে কখনই পড়তে শিখেননি। অল্প বয়সে তিনি শখের বশে রানার হয়েছিলেন, কিন্তু ‘৪৭ এর দেশভাগের সময় সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বিয়ের পরে তিনি নিজের একটি খামার গড়ে তুলেন। তিনি নিজের ছেলেমেয়েদেরও খামার করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি তার পরিবারকে খুব ভালোবাসতেন এবং প্রতিটি সদস্যের সাথেই তার খুব সখ্যতা ছিল। বেশ কিছু পারিবারিক দুর্ঘটনায় হঠাৎ করেই তার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৯২ সালে তার স্ত্রী মারা যান, তার বড় মেয়ে তৃতীয় নাতনির জন্ম দিতে গিয়ে প্রসবকালীন জটিলতায় মারা যায়, জীবনের এই ঘটনাগুলো তাকে মানসিকভাবে আঘাত দেয়। তবে ১৯৯৪ সালের আগস্টে একটি নির্মাণ দুর্ঘটনায় তার পঞ্চম পুত্র কুলদীপের মৃত্যুর পরে তিনি হতাশায় ডুবে যান এবং বেশ কিছুকাল নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাকে বেগ পোহাতে হয়েছে।
সব ভুলে বেঁচে থাকার তাগিদে ফৌজা সিং এরপরে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং ইলফোর্ডে তার এক ছেলের সাথে বসবাস শুরু করেন। । তবে সেখানে তার নির্দিষ্ট কোন কাজ ছিল না, বাড়িতে শুয়ে বসে, টিভি দেখেই দিন কাটতে লাগল। এভাবে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিয়ে যান। এখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি লন্ডন ম্যারাথন সম্পর্কে জানতে পারেন এবং ছোটবেলার রানিং আকাঙ্খার কারণে পুনরায় এই ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেন।
ফৌজা সিং ৮১ বছর বয়সে তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আচমকাই রানিং জীবনের সূচণা করেন। ৮৮ বছর বয়সে তিনি একজন অভিজ্ঞ রানার ও কোচ হরমনদার সিংয়ের কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রানিং সম্পর্কে শুরুতে তার বিশদ ধারণা ছিল না। তাই তিনি যখন রেডব্রিজ, এসেক্সে প্রশিক্ষণের জন্য এসেছিলেন, তখন তিনি থ্রি-পিস স্যুট পরেছিলেন। স্বভাবতই কোচকে তার পোশাক সহ সবকিছুর বিষয়ে পুনরায় প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছিল। ২০০০ সালের লন্ডন ম্যারাথন ছিল তার জীবনের প্রথম ম্যারাথন ইভেন্ট, যখন তার বয়স চলছিল ৮৯।
এই বিষয়ে কোচের তথ্যমতে জানা যায়, ফৌজা সিং সহজেই ২০ কিলোমিটার অবধি দৌড়াতে পারতেন এবং তিনি ম্যারাথনে অংশ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে তিনি শুরুতে কিলোমিটার আর মাইলের হিসেবে একটু গোল বাধিয়ে ফেলেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন ম্যারাথন ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের হয়ে থাকে, কিন্তু এটি যে ২৬ মাইলের (৪২ কিলোমিটার) রেস তা বুঝতে পারেননি। পরে তিনি এটি বুঝতে পেরে গুরুত্বের সাথে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
৯৩ বছর বয়সে সিং ৬ ঘন্টা ৫৪ মিনিটে একটি ম্যারাথন সম্পন্ন করেছিলেন। তখন তিনি নব্বুই এর কোঠায় থাকা বিশ্ব রেকর্ডভুক্ত পূর্বের রানারের চেয়ে ৫৮ মিনিট কম সময়ে রেস শেষ করেন। স্বভাবতই বিশ্ব তার দিকে একবার ঘুরে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। স্বল্প রানিং জীবনেও ফৌজা সিং বেশকিছু বিশ্ব রেকর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা অর্জন করেন।
ফৌজা সিং ১০০ বছর বয়সে কানাডার অন্টারিওর টরন্টোর বার্চমাউন্ট স্টেডিয়ামে স্পেশাল অন্টারিও মাস্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের রেসে একদিনে আটটি বিশ্ব রেকর্ড করার চেষ্টা করেন এবং সফল হন। তিনি ১০০ মিটার ২৩:১৪ সেকেন্ডে, ২০০ মিটার ৫২:২৩ সেকেন্ডে, ৪০০ মিটার ২:১৩:৪৮ মিনিটে, ৮০০ মিটার ৫:৩২:১৮ মিনিটে, ১৫০০ মিটার ১১:২৭:৮১ মিনিটে, এক মাইল ১১:৫৩:৪৫ মিনিটে, ৩০০০ মিটার ২৪:৫২:৪৭ মিনিটে এবং ৫০০০ মিটার ৪৯:৫৭:৩৯ মিনিটে সম্পন্ন করেন এবং একদিনে তার বয়সের জন্য পাঁচটি বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে। কিছু ইভেন্টের কোনও পূর্ববর্তী রেকর্ডধারী ছিল না, কারণ ১০০ বছর বয়সী কেউ কখনও এই দূরত্ব অতিক্রমের চেষ্টা করেনি।
এর তিন দিন পরে, ২০১১ সালের ১ অক্টোবর ফৌজা সিং টরন্টো ওয়াটারফ্রন্ট ম্যারাথনে অংশ নেন এবং বিশ্বের প্রথম শতবর্ষী রানার হিসেবে ম্যারাথন সমাপ্ত করেন। অফিসিয়ালি তার সময় লেগেছিল ৮:২৫:১৭ ঘন্টা। কিন্তু দুঃখজনক হল, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ফৌজা সিংকে সবচেয়ে বয়স্ক ম্যারাথন ফিনিশার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ তিনি তার বয়সের প্রমাণস্বরূপ জন্মসনদ উপস্থাপন করতে পারেন নি। মূলত ১৯১১ সালে ভারতে তার জন্মের কোন রেকর্ড রাখা হয়নি। তবে পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ছিল ১৯১১ সালের ১ এপ্রিল এবং দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ তার ১০০তম এবং ১০৫তম জন্মদিনে তাকে চিঠি পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি অলিম্পিক মশাল বহনের জন্যেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে স্পোর্টসওয়্যার প্রস্তুতকারক অ্যাডিডাসের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে ডেভিড বেকহ্যাম এর পরিবর্তে ফৌজা সিং-কে ব্র্যান্ডিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ফৌজা সিং তার ১০২ বছর পূর্ণ হওয়ার পাঁচ সপ্তাহ পূর্বে ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হংকংয়ের ম্যারাথনে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দৌড় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি হংকংয়ের ম্যারাথনে ১০ কিলোমিটার রান ১ ঘন্টা ৩২ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে শেষ করেছেন । এরপর থেকে প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ না নিলেও তিনি নিজের আনন্দ, সুসাস্থ্য ও দাতব্য উদ্দেশ্যে দৌড়াতে চান।
ধূসর শশ্রুমণ্ডিত, প্রথাগত শিখ পাগড়ী পরিহিত এবং ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা ফৌজা সিং এখন ম্যারাথন দুনিয়ায় খ্যাতি পেয়েছেন ‘পাগড়ী টর্নেডো’ নামে। সিএনএন কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিং বলেছেন, তার ৯৪ বছর বয়সে বাম পায়ে হাড়ের ঘনত্ব ছিল ৩৫ বছর যুবকের ন্যায় এবং ডান পায়ে হাড়ের ঘনত্ব ছিল ২৫ বছর যুবকের ন্যায়। তিনি আরও বলেন, “আমার বয়স বাড়ার কারণে আমি অবসর নিয়েছি, আমার শরীর কিছুটা অবনতি হয়েছে, কিন্তু অবসর আমাকে দমিয়ে দেয়নি। আমি খুব সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি। আমি দিনে তিন থেকে চার ঘন্টা হাঁটি, বাচ্চাদের সাথে খেলা করি এবং আমার সমস্ত দিনের কাজ নিজেই করি। আমি হয়তো আরও এক বছর রান চালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে একদিন অবসর গ্রহণ করতে হবে।”
ভারতের পাঞ্জাবে নিজ এলাকায় বেড়াতে আসবার সময়ে নেওয়া তার একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। সব বয়সী রানারদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা হয়েই রয়ে যাবেন দীর্ঘদিন। বয়স কোন বাধা নয়, বরং সদিচ্ছা আর মনোবলই একজন রানারের নেপথ্য শক্তি।
আপনি দৌড়ান কেন?
ফৌজা সিং: দৌড়ই স্ত্রী ও সন্তান হারানোর দুঃখ ভুলিয়ে রাখে আমাকে। যখন দৌড়াই, মনে হয় ঈশ্বরের সান্নিধ্যেই আছি আমি। এতে ভালো ও ফিট আছি।
দৌড়ানোটা কী নিত্য রুটিনেরই অংশ?
ফৌজা সিং: আমি যদি না-ও দৌড়াই, দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করি।
ম্যারাথনের জন্য অনুশীলন করা কতটা কঠিন?
ফৌজা সিং: আমার ওজন ৫৫ কেজি। ট্রেনারের অধীনে অনুশীলন শুরুর পর আমি এটাকে ৫২ কেজিতে নামিয়ে এনেছিলাম। অনুশীলনটা কঠিন হলেও আমার গাঁটে গাঁটে যে ব্যথা ছিল, সেটা এতে দূর হয়েছে।
এই বয়সেও আপনি এত স্লিম। কী খান?
ফৌজা সিং: মূল খাবার হিসেবে সামান্য ডালের সঙ্গে একটা রুটি। গরমের সময় প্রচুর আম খাই। আর প্রতিদিন একটা করে লাড্ডু।
আপনার ফিটনেসে ডাক্তাররাও বিস্মিত…
ফৌজা সিং: পাঁচ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত আমি হাঁটতে পারিনি। আমার পা শক্ত হয়েছে ১৫ বছর বয়সে। এখন ডাক্তাররা দেখছেন, সেই পা দুটোই এ বয়সেও আমার দৌড়ানোর বড় শক্তি।
যাঁরা ম্যারাথন দৌড়াতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ফৌজা সিং: বাজে চিন্তা এবং বাজে লোকের সঙ্গ এড়িয়ে সবকিছু উপভোগ করো।
পাঞ্জাব সরকার আপনার অর্জনকে স্বীকৃতি দেয়নি। এতে ব্যথিত হননি?
ফৌজা সিং: আমি যা করছি, সেটা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নয়। পাঞ্জাব আমার জন্মভূমি-এর জন্য ভালোবাসা আছে আমার।
প্রতিবছরই পাঞ্জাবে আসেন। কী পরিবর্তন লক্ষ করছেন?
ফৌজা সিং: যা হচ্ছে, সেটা অবিচার। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা বলে কিছু নেই। বাড়ির বাইরে বেরোতে চাইলে পরিবারের লোকজন মানিব্যাগ এবং ঘড়ি আমার কাছ থেকে নিয়ে রাখে। কারণ, বাইরে বেরোলেই মাদকাসক্ত লোকজনের হাতে সেগুলো খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দৌড়বিদ হিসেবে গিনেস বুক আপনাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
ফৌজা সিং: এতে কী আসে-যায়? আমি তাদের কাছে যাব না। তারাই আসবে আমার কাছে।
যা আয় করেন, তা খরচ করেন কীভাবে?
ফৌজা সিং: বয়স্কভাতা হিসেবে আমি সপ্তাহে ১৩০ পাউন্ড পাই। এক কানাকড়িও নিজের কাছে রাখি না। জমিজমা কিংবা অন্য কোনো সম্পদও নেই আমার। ইংল্যান্ডে থাকি ছেলের সঙ্গে। খরচও নেই বললেই চলে। এই শীতে ভারতে এসেছি দেড় লাখ রুপি নিয়ে। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে কিছু বাঁচলে খেলাধুলা করার জন্য গ্রামবাসীকে দিয়ে যাব।
• সম্পাদনা: Run for Unity in Diversity
• তথ্যসূত্র: সিএনএন, রিলিজিওন নিউজ, প্রথম আলো
3rd BARISHAL MARATHON 2024
Run for Unity in Diversity