DHAKA International 10K

Where Every Step Tells a Story!

যে দৌড় ছিল তার জীবনের লড়াই লতা ভগবান কারে

যে দৌড় ছিল তার জীবনের লড়াই লতা ভগবান কারে

লতা ভগবান কারে

ম্যারাথনের ঠিক আগের রাতেই তার প্রচন্ড জ্বর ওঠে। শরীরের এই অবস্থায় ছেলে বার বার নিষেধ করছিল দৌড়ে অংশ না নিতে। কিন্তু তার পক্ষে এই ম্যারাথনটি হাতছাড়া করার কোন সুযোগ ছিল না। নাহ, নিতান্ত নাম কুড়ানো বা পুরষ্কারের হাতছানি নয়, বরং এটি ছিল পরিবারের আপনজনকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য সামান্য কিছু টাকা জোগাড়ের প্রশ্ন। যদিও তিনি ভালো করেই জানতেনই না ম্যারাথন কি, কীইবা তার নিয়মকানুন; শুধু এটুকুই শুনেছেন যদি দৌড়ে জিততে পারেন তাহলে তিনি পুরষ্কার হিসেবে পাবেন ৫০০০ রুপি! নিজের আনন্দ, অর্জন কিংবা কাট-অফ টাইমিং চ্যালেঞ্জকে পাল্লা দিতেই শুধু নয়, কখনো কখনো ম্যারাথন আমাদের সামনে বাস্তব জীবনের এমন কিছু গল্প হাজির করে যা হয়তো নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আড়ালেই থেকে যেত।এই গল্প কোন সেলিব্রিটির নয়, এই গল্প নিতান্তই জীবনের গল্প।

২০১৩ সাল। ভারতের মহারাষ্ট্রের বারামতি থেকে কয়েক মাইল দূরের গ্রাম পিম্পলি। সেখানে ছোট্ট একটি ঘরে পাঁচজনের সংসার। ভগবান কারে, তার স্ত্রী লতা কারে এবং তাদের ছেলে সুনীল, তার স্ত্রী ও নাতি। বছর চারেক আগে তারা বুলধানা থেকে কাজের সন্ধানে এখানে বসতি গেড়েছেন। ভগবান ও লতা পেশায় দিনমজুর। মজুরি থেকে মাসে তাদের আয় আসত মাত্র ৩-৪ হাজার রুপি। এই রোজগার তাদের খাবার সংস্থানের জন্যও পর্যাপ্ত ছিল না।

এই দুরবস্থার জীবনের মাঝেই ভগবান কারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে লতার ঘাড়ে। এদিকে ছেলে সুনীলেরও তেমন রোজগার নেই। দিনমজুরি করে দিনে ৮০-১০০ রুপি আয় হয়, যা পেট চালাতেই শেষ হয়ে চলে যায়। চিকিৎসা ব্যয় করার মতো বাড়তি সঞ্চয়ও নেই।

নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে লতা কারে

ভগবানের হার্টের সমস্যা থাকায় ডাক্তার তাকে এমআরআই স্ক্যান করাতে বলেন। চিকিৎসার জন্য তাদের সব মিলিয়ে ১৫-২০ হাজার রুপি জোগাড় করতে হবে। যেখানে সংসার চালানোই দায় সেখানে একসাথে এতোগুলো টাকা ব্যবস্থা করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলেন লতা। তবে তিনি প্রতিবেশীদের কাছে হাত পাতা বা ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেননি। এই সময় তাদের প্রতিবেশী সুধীরের মাধ্যমে বারামতি ম্যারাথন সম্পর্কে জানতে পারেন। আরেক প্রতিবেশী তার মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে এখানে দৌড়ে অংশ নিয়ে জিততে পারলে পুরষ্কার হিসেবে টাকা পাওয়া যাবে। লতার মাথায় তখন টাকা রোজগারের ভাবনাই কাজ করছিল। তাই আর আগ-পিছ না ভেবে সিদ্ধান্ত নেন ম্যারাথনে অংশ নিতে। লতার বয়স তখন ৬১ বছর।

ট্র্যাকে আকর্ষণীয় পোশাক, স্পোর্টস স্যু পড়া প্রতিযোগীদের মাঝে বিবর্ণ চেহারার রোগা শরীরের ষাটোর্ধ কোন নারী আটপৌড়ে সুতি ছাপা শাড়ি হাঁটুর ওপর মালকোঁচা দিয়ে পড়ে, খালি পায়ে দৌড়ে চলেছেন এই দৃশ্য দেখতে আমরা একেবারেই অনভ্যস্ত

আমরা ম্যারাথনে কোন নারী বা পুরুষ দৌড়বিদকে স্পোর্টস স্যু, রানিং শর্টস বা ট্র্যাক প্যান্ট পরিহিত, হয়তো চোখে রোদচশমা, সাথে পানির বোতল, ঘাম মোছার রুমাল, ভীড়ের মধ্যেও নিজেকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস এসব দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু বিবর্ণ চেহারার রোগা শরীরের ষাটোর্ধ কোন নারী আটপৌড়ে সুতি ছাপা শাড়ি হাঁটুর ওপর মালকোঁচা দিয়ে পড়ে, খালি পায়ে দৌড়ে চলেছেন এই দৃশ্য দেখতে আমরা একেবারেই অনভ্যস্ত। বারামতি ম্যারাথনে অংশ নেওয়া ৯,৫০০ এরও বেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে তাই খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি কেড়েছিলেন লতা। ট্র্যাকে আকর্ষণীয় পোশাক, স্পোর্টস স্যু পড়া প্রতিযোগীদের মাঝে নিজের লজ্জা বিসর্জন দিয়ে, মানুষের ব্যঙ্গ উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসে ভর করেই লক্ষ্য পূরণের আশায় ছুটছিলেন লতা।

বিজয়ী লতা ভগবান কারে

২০১৩ সালেই প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় বারামতি ম্যারাথন। তাই অল্প পরিসরের এই আয়োজনে মোট চারটি ক্যাটাগরি ছিল। সিনিয়র সিটিজেন ক্যাটাগরিতে তিন কিলোমিটার রেসে অংশ নেন লতা এবং সবাইকে তাক লাগিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে নিকটতম রানারকে পেছনে ফেলে তিনিই প্রথম স্থান জয় করেন। প্রথমবার ম্যারাথনে নাম দিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলেন লতা। তিনি নিজেও ভাবেননি জিততে পারবেন, তিনি নিজেই জানালেন, ‘এই দৌড় ছিল আমার জীবনের লড়াই। জিতলে প্রাণ বাঁচবে। তাই সাহস ফিরে আসে। সবকিছু পেছনে ফেলে লক্ষ্য স্থির করি। আর তাতেই জয় আসে।’

তার জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র Lata Bhagwan Kare

দারিদ্রের সংসারে রুটি-সবজির মতো সাধারণ খাবারই ছিল তাদের প্রতিদিনের রুটিন, পুষ্টিকর খাবারের যোগান দেওয়া তাদের সম্ভব ছিল না। তাই শারীরিক সক্ষমতা যতোটা নয়, বরং মনের জোরই ছিল তার আসল। আর তার দৌড়ানোর কোন অভিজ্ঞতা বা অনুশীলন আগে কখেনোই ছিল না, কিন্তু ছিল হাঁটার অভ্যেস, তাও প্রয়োজনেই। তার তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে কাছেপিঠে, গড়ে ৩-৪ কিলোমিটারের পথ। তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতের কারণেই হাঁটার প্রয়োজন পড়তো। এছাড়া দৈনন্দিন বাইরের কাজে পা দুটোই তার সম্বল। তার জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র Lata Bhagwan Kare মুক্তি পেয়েছে এবছরের ১৭ জানুয়ারি।

লতা ভগবান কারে এখনো নিয়মিত দৌড়ে চলেছেন। তার ৬৮ বছর বয়সেও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গার ম্যারাথনে সিনিয়র সিটিজেন ক্যাটাগরিতে হাজির হয়ে যান। তার আত্মবিশ্বাসী মুখে এখন আর শঙ্কার ছিটেফোঁটাও নেই। লজ্জা-সংকোচকে জয় করেছেন তিনি। শখ নয়, বরং পেটের টানে প্রশিক্ষিত দৌড়বিদদের পিছনে ফেলে ছুটে চলেন এই জীবনের রানার।

  • সম্পাদনা: কসমিক কালচার
  • সূত্র: বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া
Published on: Monday, 4 May 2020, 09:10 pm | Last update: Saturday, 14 September 2024, 09:28 pm | Total views: 1766.

DHAKA International 10K

Where Every Step Tells a Story!